মো: শহীদুল হক :: গত ২৭ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বনাম শিক্ষাবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত ড. মেজবাহ কামালের যে কয়টি কথা জেনেছি, তার প্রায় প্রতিটি অসত্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক যদি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অবাস্তব আর ভিত্তিহীন বক্তব্য দেন, তবে তা গোটা শিক্ষকসমাজের জন্যই অপমানজনক নয় কি?
তিনি বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি উচ্চতর মাদরাসায় পরিণত হয়েছে। বক্তব্যটি অবান্তর কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। মাদরাসার শিক্ষার্থী বেড়ে গেলেই সে প্রতিষ্ঠান মাদরাসায় পরিণত হয় না। ঢাবির কারিকুলাম, ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা সবই রয়েছে বহু নামীদামি অধ্যাপকের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সব শিক্ষকই স্কুল-কলেজ থেকে আসা। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই শিক্ষকদের জন্য মাদরাসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া তো স্বস্তির বিষয় হওয়া উচিত। কারণ, যাদের তারা ‘সাম্প্রদায়িক’ বলছেন; তাদের চার-পাঁচ বছর সময় ধরে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ শিক্ষা দিতে পারবেন। কিন্তু উল্টো তাদের কেউ কেউ কৌশলে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছেন।
কামাল বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থীদের ৬০ শতাংশ মাদরাসা থেকে আসা। এই বক্তব্য সঠিক ধরে নিলে বলতে হবে, মাদরাসার ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির যোগ্য বিধায় এরূপ ঘটছে। তবে নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তার এই বক্তব্য কোনো বাস্তব তথ্য-উপাত্তনির্ভর নয়, বরং ভুল ধারণাপ্রসূত। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ঢাবিতে ভর্তি ঠেকানোর পটভূমি তৈরি করা হচ্ছে।
ওই অধ্যাপক বললেন, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফোরের মানের ইংরেজি পড়ে ঢাবিতে ভর্তি হচ্ছে। এমন বক্তব্য শুধু বানোয়াটই নয়, ঢাবির জন্য চরম অপমানজনকও। দেশের এই বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজিতে বেশ ভালো নাম্বার পেতে হয়। মাদরাসার ছাত্ররা কখনো ইংরেজিতে সর্বোচ্চ মার্কসও পাচ্ছে। তার বক্তব্য সঠিক হলে ঢাবির প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। ক্লাস ফোরের প্রশ্নপত্র প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা তৈরি করেন। তবে কি ঢাবির সুযোগ্য শিক্ষকেরা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সমমানের বলে বিশ্বাস করতে হবে। মাদরাসা ও স্কুলের সিলেবাস সম্পর্কে না জেনে বলা হয়েছে, মাদরাসার আলিম (এইচএসসি) ক্লাসে স্কুলের ক্লাস ফোরের মানের বই পড়ানো হয়। এ অভিযোগের সত্যতা নেই। মাদরাসাগুলোতে যখন ১০০ মার্কসের ইংরেজি ছিল, তখনো এইচএসসির সিলেবাসের মতোই ছিল। বাংলা ও ইংরেজিতে ২০০ মার্কসের যৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শর্তারোপের কারণে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা কয়েক বছর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভর্তি হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এরপর ২০১৫ সাল থেকে দাখিল ও আলিমে বাংলা ও ইংরেজিতে ২০০ করে মার্কস রেখে এসএসসি ও এইচএসসির সিলেবাসই পড়ানো হচ্ছে মাদ্রাসাতে। এগুলো পড়াচ্ছেন কলেজ-ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করা, অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকেরা।
মেজবাহ কামাল বলেছেন, মাদরাসায় নম্বর দেয়া শুরু হয় বোধহয় ৯০ থেকে, আর পারলে ১০০-তে ১০০-এর চেয়ে বেশি মার্কস দেয়া হয়। এ বক্তব্যটি হাস্যকর সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্টের সাথে মাদরাসা বোর্ডের রেজাল্ট মিলিয়ে দেখলেই এমন বক্তব্যের ভিত্তিহীনতা স্পষ্ট হবে। পেছনের পরীক্ষার কোনো মার্কসই যোগ করার দরকার নেই, শুধু ভর্তি পরীক্ষার মার্কস দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করুন। তাহলে এটা আরো স্পষ্ট হবে যে, মাদরাসার ছাত্ররা নিজ যোগ্যতা বলেই ভর্তি হতে সক্ষম।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়